ক্যানসার চিকিৎসা জাতীয় তহবিল যেভাবে গঠন করা যায়

সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৪

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১৩-১৫ লাখ। ক্যানসার একদিকে যেমন মরণঘাতী, অন্যদিকে এর চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেশি। বছরে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয় ক্যানসারের ধরন অনুযায়ী ৫-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিলে ব্যয় আরও বেড়ে যায়। সাধারণ পরিবারের পক্ষে এ ব্যয় নির্বাহ করা অত্যন্ত দুরূহ। ক্যানসারের ব্যয় বহন করতে গিয়ে অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা যায়, যেসব পরিবারে ক্যানসারের রোগী আছেন, তাঁদের প্রায় ১৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই এই বিপুল পরিমাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য বিকল্প অর্থায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। যদিও স্বাস্থ্যবিমা একটি পরীক্ষিত বিকল্প পদ্ধতি, তবে বড় পরিসরে স্বাস্থ্যবিমা চালুর জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন, বাংলাদেশে তা এখনো তৈরি হয়নি।

তাই ক্যানসার চিকিৎসার অর্থায়নের জন্য বিমাব্যবস্থা এই মুহূর্তে প্রচলন করা সম্ভব নয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ক্যানসার চিকিৎসার একটি জাতীয় তহবিল গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এ তহবিলের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হলো।

জাতীয় পর্যায়ে ক্যানসার চিকিৎসা তহবিল গঠনের জন্য সমাজের সর্বমহলের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান যেমন প্রয়োজন, তেমনি উন্নয়ন অংশীজনসহ বিভিন্ন মানবহিতৈষী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক অংশগ্রহণও প্রয়োজন। এ ছাড়া বিভিন্ন উদ্ভাবনী কৌশল অবলম্বনও করা যেতে পারে।

দেশে বর্তমানে প্রায় ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার সক্রিয় মোবাইল ফোন গ্রাহক রয়েছেন। তাঁদের থেকে মাসে ২০ টাকা করে সংগ্রহ করলে বছরে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব।

তামাক ও তামাকজাত পণ্য থেকে সরকার বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ ট্যাক্স বাড়ানো হলে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগৃহীত হবে, যা এই তহবিলে যোগ করা যেতে পারে। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ করলে একদিকে রাজস্ব বাড়বে, অন্যদিকে এসব পণ্যের ব্যবহার কমার ফলে ক্যানসারের ঝুঁকিও কমবে।

তা ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, ব্যাংক, বিমা, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর) একটা অংশ এই তহবিলে প্রদানের জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে। অধিকন্তু, বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীজন এবং বিভিন্ন মানবহিতৈষী ব্যক্তিরা এতে অবদান রাখতে পারেন।

প্রবাসী বাংলাদেশিরাও দেশের মানুষের ক্যানসার চিকিৎসার খরচ জোগাতে এই তহবিলে অবদান রাখতে পারেন। সর্বোপরি, অ্যালকোহল, বিভিন্ন এনার্জি ড্রিংকসসহ ক্ষতিকর পানীয়ের ওপর অতিরিক্ত ২-৩ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর যুক্ত করে অর্জিত রাজস্ব এ তহবিলে যোগ করা যেতে পারে। এভাবে বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে, যাঁরা ক্যানসার চিকিৎসা গ্রহণ করেন, তাঁদের এই তহবিল থেকে বছরে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার একটি অর্থসহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। এটি করতে পারলে এদিকে যেমন মানুষ সময়মতো ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে পারবেন, অন্যদিকে ক্যানসারে আক্রান্ত পরিবারের দরিদ্র হয়ে যাওয়ার হার হ্রাস পাবে। তাই এই তহবিল ক্যানসারে আক্রান্ত পরিবারের দরিদ্র হওয়া প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করবে এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।

কিন্তু এ ধরনের তহবিল গঠন করতে সরকারকে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। যেমন মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের সবার ওপর সমভাবে মাসে ২০ টাকা আরোপ করলে তাঁদের অবদানের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, সম্পদশালী মানুষ যে হারে অবদান রাখবেন, দরিদ্র মানুষও সেই একই হারে অবদান রাখবেন। কিন্তু এই তহবিল সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রবেশগম্যতা বেশি থাকবে। কেননা এই তহবিল কেবল দেশের ভেতরে যাঁরা চিকিৎসা নেবেন, তাঁদের জন্য নির্ধারণ করা হবে।

সম্পদশালী ব্যক্তি যাঁরা দেশের বাইরে গিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা নেবেন, তাঁদের এই তহবিল থেকে কোনো অর্থায়ন করা হবে না। এভাবে একপ্রকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া সমহারে ২০ টাকা আরোপের পরিবর্তে সম্ভব হলে মোবাইল ফোনের কল রেটের ওপর ১ থেকে ৫ পয়সা আরোপ করে তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের থেকে তহবিল সংগ্রহের একটা রাজনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার নানা সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে। তবে সরকার যদি এ ধরনের তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা এবং এ তহবিলের সুবিধা জনগণকে সঠিকভাবে জানাতে পারে, তাহলে এর রাজনৈতিক ঝুঁকি কমে যাবে। তা সত্ত্বেও এ ধরনের ঝুঁকি নিতে না চাইলে সরকার তার নিয়মিত রাজস্ব থেকে বছরে ৪ হাজার কোটি টাকা এ তহবিলে দিতে পারে।

অন্যদিকে তামাক ও তামাকজাত পণ্য অ্যালকোহল ও এনার্জি ড্রিংকসের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করলে বিভিন্ন কায়েমি মহলের যে স্বার্থহানি হবে, তা সরকারকে দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। মোদ্দাকথা, এ তহবিলগঠনের জন্য সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আর তা করতে পারলে দেশে ক্যানসার প্রতিরোধ, ক্যানসার গবেষণা এবং ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয় বহন অধিকতর সহজ হবে।

এই তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য ওপরে উল্লিখিত বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ, সন্নিবেশন এবং ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় এই তহবিল খরচের এখতিয়ারের বিধান রেখে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করা প্রয়োজন। এই প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশন হতে পারে। এর জন্য কোনো আইনগত ভিত্তির প্রয়োজন হলে তা প্রণয়ন করে সরকার এই প্রতিষ্ঠান গঠন করতে পারে। উল্লেখ্য, সরকার ২০১৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইনের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট গঠন করেছে, যেখানে সরকারি অনুদান ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদে ক্যানসার সারভাইভারদের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ক্যানসার সারভাইভারদের মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করা যেতে পারে। তা ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ক্যানসার গবেষক, একাডেমিশিয়ান, সাংবাদিক, ক্যানসার সংগঠক, ক্যানসারে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্য এবং ক্যানসার পরিচর্যাকারীরাও পরিচালনা পরিষদের সদস্য হতে পারেন।

দিন দিন ক্যানসারের বিস্তার যেমন বাড়ছে, ক্যানসার চিকিৎসার খরচও তেমনি বাড়ছে। এই রোগ প্রতিরোধের জন্য সর্বমহলের অংশগ্রহণ যেমন প্রয়োজন, তেমনি এর চিকিৎসার খরচের অর্থায়নের জন্য সরকার, সাধারণ জনগণ, উন্নয়ন অংশীজন, মানবহিতৈষী ব্যক্তি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা এগিয়ে এলে জাতীয় পর্যায়ে একটি ক্যানসার চিকিৎসা তহবিল গঠন করা সম্ভব।

সঠিক আইনি কাঠামোর মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন এবং ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদে ক্যানসার সারভাইভারসহ যোগ্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন, ক্যানসার প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং ক্যানসার গবেষণা পরিচালনা করা অনেকাংশে সহজ হবে। আশা করি সরকার এ ধরনের তহবিল গঠনে অগ্রগামী হবে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: https://www.prothomalo.com/opinion/column/2pls9hm7up