প্লাস্টিক টাইমবোমা ও মাইক্রোপ্লাস্টিকস

প্রভাবশালী বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে বছরে ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হচ্ছে। প্রবন্ধকার ধারণা করছেন যে ২০৫০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে ৮০ কোটি টন। তাঁর বর্ণনায় : ‘আগামীকাল যদি পৃথিবীর সব জায়গায় প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করেও দেওয়া হয়, তাহলেও বর্তমানের ৫০০ কোটি টন প্লাস্টিক ভেঙে ভেঙে মাইক্রোপ্লাসটিকস হতে থাকবে। ’ ধারণা করা যায় যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো অবিরাম ঢুকতে থাকবে খাদ্যশৃঙ্খল তথা বাস্তুতন্ত্রে।

মানবদেহ ক্রমাগত প্লাস্টিক দূষকের দ্বারা হবে দূষিত। এ ধরনের অবস্থাকে ওয়েজিনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (নেদারল্যান্ডস) অধ্যাপক এ কোলম্যান ‘প্লাস্টিক টাইমবোমা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আসলেই মাইক্রোপ্লাস্টিক তথা প্লাস্টিকদূষণ এখন গোটা পৃথিবীতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। সাধারণত পাঁচ মিলিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। এখন জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সব জায়গাতেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিপুল উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এসংক্রান্ত দুঃসংবাদ হচ্ছে, মাইক্রোপ্লাস্টিকস মানবদেহে প্রবেশ করেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

এ বছর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি সংক্রান্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের লিভার, মাতৃদুগ্ধ ও রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের নমুনা খুঁজে পেয়েছেন। এর আগে মানুষের মল, অমরা (গর্ভাশয়ের ভেতরে একধরনের টিস্যু, যেখান থেকে ডিম্বক সৃষ্টি হয়। ইংরেজিতে প্লাসেন্টা) ও ফুসফুস থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিকস পাওয়া গিয়েছিল। গবেষণার এই ফলাফলগুলো মানবদেহের সব তন্ত্রেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির আশঙ্কা তৈরি করেছে। ধারণা করা যায় যে প্রধানত খাবার, পানীয় ও বাতাসের মাধ্যমে এগুলো মানবদেহে প্রবেশ করছে।

তিন দশক আগে প্লাস্টিকদূষণ আলোচনায় মাইক্রোপ্লাস্টিক শব্দটি শোনা যেত না। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্লাস্টিকদূষণের ওপর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি থিসিস তত্ত্বাবধান করেছিলাম, তখন মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে কোনো শব্দ ছিল না। থাকার কথাও না। কারণ মাইক্রোপ্লাস্টিক শব্দটি ২০০৪ সালে বিখ্যাত পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে প্রথম ব্যবহার করা হয়। প্রবন্ধটির লেখক ছিলেন অধ্যাপক রিচার্ড সি থমসনসহ মোট আটজন। খুব ছোট সেই প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘সমুদ্রে হারিয়ে : কোথায় সব প্লাস্টিক?’

মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে এদের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি, এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিকস (মাইক্রোবিডস) কারখানায় বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। এগুলো সাধারণত টুথপেস্ট, চুলের জেল, বিশেষ ধরনের ক্রিম (ক্লিনজিং মিল্ক), এয়ার ফ্রেশনার ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। আমরা যখন এগুলো ব্যবহার করি তখন এসব দ্রব্য পানির সঙ্গে মিশে নর্দমার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে তা পরিবেশে উন্মুক্ত হয়। সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিকস সাধারণত প্লাস্টিকের তৈরি নানা ধরনের দ্রব্য ভেঙে তৈরি হয়। প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন জিনিস (সিনথেটিক পেইন্টসহ) সাধারণত সূর্যালোক, তাপমাত্রা, ঘর্ষণ, বাতাস, পানির ঢেউ, স্রোত ইত্যাদি কারণে ভেঙে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়। সেগুলোকে সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিকস বলা হয়।

বিজ্ঞানীরা গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের প্রথম দিকেই জীবদেহে প্লাস্টিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছিলেন। বিগত দুই দশকে সামুদ্রিক, মিঠা পানি ও অন্যান্য জায়গার জীবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকসের উপস্থিতি সংক্রান্ত বহুসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এসব গবেষণার ফলাফল সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করছে যে মাইক্রোপ্লাস্টিকস আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়েছে। অর্থাৎ আমাদের বাস্তুতন্ত্র এখন মাইক্রোপ্লাস্টিকস তথা প্লাস্টিকদূষকের বিপুল উপস্থিতিতে ভয়ানকভাবে আক্রান্ত। ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে ৮০০ জীব প্রজাতির ৮৭ হাজার সদস্যের মধ্যে প্রত্যেকের দেহে গড়ে চারটি করে প্লাস্টিক কণা পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এ বছর (২০২২) প্রকাশিত একটি গ্রন্থে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে প্রাপ্ত মাইক্রোপ্লাস্টিকস সম্পর্কে বলা হয়েছে। এসব খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মাছ, শুঁটকি, ঝিনুক, কাঁকড়া (সামুদ্রিকসহ); চাল, মধু, শাক-সবজি, ফল, মাংস, লবণ, চিনি, দুধ, মদ, বিয়ার, ট্যাপের পানি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত খাদ্যদ্রব্যের অনেকগুলোতে প্রাপ্ত মাইক্রোপ্লাস্টিকসের আকার, সংখ্যা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাসায়নিকের নামও দেওয়া হয়েছে। এই তথ্যগুলো আমাদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ তৈরি করে যে আমরা এই মুহূর্তে যে খাবারগুলো খাচ্ছি, তা মাইক্রোপ্লাস্টিকসমুক্ত তো?

মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকস প্রবেশ করার পর কিভাবে এবং কোন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, নির্দিষ্টভাবে তার বিস্তারিত পরীক্ষা করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর ওপর এবং পরীক্ষাগারে কালচার করা মানব কোষের ওপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া গেছে। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে যে মাইক্রোপ্লাস্টিকস প্রাণী শারীরবৃত্তের বিভিন্ন কার্যক্রম (প্রজনন, রক্তসংবহন, রেচন, পরিপাক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, হৃৎপিণ্ডের কাজ, স্নায়ুতন্ত্রের কাজ ইত্যাদি) বাধাগ্রস্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্লাস্টিক তৈরিতে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলো জীবকোষের জন্য ক্ষতিকর। মাইক্রোপ্লাস্টিকসের কারণে প্রাণী ডিএনএ তথা কোষেরও ক্ষতি হয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে বলে বলা হচ্ছে। আশা করা যায়, মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকসের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার বিস্তারিত ফলাফল অচিরেই জানা যাবে।

আসলে প্লাস্টিককেন্দ্রিক সমস্যা বহুমাত্রিক। ওপরে বর্ণিত সমস্যা ছাড়াও আমরা জানি যে প্লাস্টিকের কারণে জলাবদ্ধতা, মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট, সমুদ্রসহ সব ধরনের জলাশয় ও জলচর জীবের ক্ষতিসাধন ইত্যাদি হয়ে থাকে। তবে প্লাস্টিককেন্দ্রিক আরো সমস্যা আছে। ল্যানসেট গ্রুপের একটি জার্নালে প্রকাশিত (প্লানেটরি হেলথ : ২০২২) একটি লেখায় প্লাস্টিক অব্যবস্থাপনার কারণে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিরও বিস্তার ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাদ দেওয়া নানা রকম প্লাস্টিকে জমে থাকা পানি ও নোংরা আবর্জনায় বিভিন্ন রোগজীবাণু বহনকারী কীট-পতঙ্গসহ অন্যান্য জীবের বংশবিস্তার ঘটে এবং সহজেই সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্লাস্টিককেন্দ্রিক আরো একটি কঠিন সমস্যা, যা আমাদের আলোচনায় আসে না বললেই চলে। সেটি হচ্ছে, অধিকাংশ প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি। ‘নেচার রিভিউ’ জার্নালের সম্পাদকীয় (ফেব্রুয়ারি ২০২২) অনুযায়ী প্লাস্টিক তৈরির প্রক্রিয়া থেকে তার রিসাইকল ও পোড়ানো পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যয় হবে প্লাস্টিক তৈরিতে এবং তার জন্য বৈশ্বিক কার্বন ভাণ্ডারে ১৫ শতাংশ যোগ হবে প্লাস্টিক থেকেই। কাজেই প্লাস্টিক সমস্যা এক কঠিন ও জটিল সমস্যা।

বাংলাদেশেও প্লাস্টিকদূষণ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২১ নভেম্বর ২০২২ ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্লাস্টিকদূষণের দেশ, যেটি চিন্তার কারণ (কালের কণ্ঠ : ২১/১১/২২)’। ‘বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র ২০২১ সালে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী দেশে পাঁচ হাজারের মতো প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। রপ্তানি বিচারে এই শিল্পের অবস্থান দ্বাদশ। বিখ্যাত এলসিভিয়ার গ্রুপের একটি জার্নালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের কয়েকজন গবেষকসহ দেশি-বিদেশি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের লেখা এক প্রবন্ধ (সিদ্দিকী ও অন্যান্য : ২০২২) অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিকের (ফিনিশড প্রডাক্ট) পরিমাণ ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৩০৬ মেট্রিক টন; মাথাপিছু ব্যবহার ও বর্জ্য তৈরির পরিমাণ যথাক্রমে ১০.১৩ ও ৭.৯ কেজি।

যদিও অনেক দেশের তুলনায় আমাদের মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ও বর্জ্য তৈরির পরিমাণ কম, তবু প্লাস্টিক অব্যবস্থাপনার হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ১০ টি দেশের মধ্যেই। সমস্যাটা এখানেই। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য পুকুর, খাল, বিল, নদী ও সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। কৃষিজমি, বনভূমি, সৈকতসহ স্থলভূমির প্রায় সব জায়গায়ই প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি গবেষণায় বাংলাদেশে কৃষিজমি, সমুদ্রসৈকত, নদীসহ বিভিন্ন জায়গায় মাইক্রোপ্লাস্টিকস পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সামুদ্রিক শুঁটকিতেও মাইক্রোপ্লাসটিকস মিলেছে। এ ধরনের গবেষণার বিস্তৃতি ঘটালে বাংলাদেশে অনেক জীব-প্রজাতির দেহে ও খাদ্যশস্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকস পাওয়ার আশঙ্কা করা যায়। বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগের।

বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিকস তথা প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করতে হলে এর অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে হবে। এসংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়াও উন্নত দেশগুলোর প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের উপযোগী করে অনুসরণ করা যেতে পারে। প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার মূল দর্শন হওয়া উচিত মানুষ যেন ব্যবহৃত প্লাস্টিক ফেলে না দেয়। বিষয়টি কার্যকর করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বিশেষ করে একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে ২ মার্চ ২০২২ ইউএন অ্যাসেম্বলিতে পাস হওয়া ‘বৈশ্বিক প্লাস্টিক চুক্তি’ আমাদের মান্য করা প্রয়োজন। এই চুক্তিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি মেনে চললে আশা করা যায়, বাংলাদেশে প্লাস্টিকদূষণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।

লেখক :

বিধান চন্দ্র দাস

অধ্যাপক (পিআরএল)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়